পিসির বাড়িতে
- Written By : Rita Braganza
- Story Type : Crossdressing, Male to Female Transformation, Self-Love, Boy In Saree, Transformation, Way of living
- Image Courtsey : Pinterest

অরণ্য ছোটবেলা থেকেই একটু অন্যরকম ছিল। তার পছন্দের জগৎ ছিল কল্পনার মতো সুন্দর—রঙিন শাড়ি, ঝলমলে গয়না, আর মেয়েদের সাজগোজ। মা যখন সকালে সাজগোজ করে কাজে বের হতেন, অরণ্য মুগ্ধ হয়ে দেখত তার মায়ের পরা শাড়ির আঁচল আর টিপ। কখনও কখনও মায়ের অবর্তমানে সে চুপিচুপি আলমারির সামনে দাঁড়িয়ে মায়ের শাড়ির কোণা ছুঁয়ে দেখত। শাড়ির মোলায়েম কাপড়ে তার মনে হতো, যেন কোনো স্বপ্নে ঢুকে যাচ্ছে সে।
কিন্তু এসব কথা কারও সঙ্গে কখনও শেয়ার করতে সাহস পায়নি অরণ্য। বাবা তাকে বরাবরই “ছেলে মানুষদের মতো” গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন—”ছেলেরা শক্ত হয়, ছেলেদের সাজগোজ মানায় না”—এমন ধারণাগুলো তার মনে কাঁটার মতো বিঁধে থাকত। তাই শাড়ি, গয়না, কিংবা মেয়েদের সাজের প্রতি তার অমোঘ টান গোপনই রয়ে গিয়েছিল।
অরণ্যর সবচেয়ে কাছের বন্ধু ছিল তার সুলতা পিসি। পিসি ছিলেন স্বতন্ত্র, স্বাধীনচেতা নারী। তিনি সাজগোজ করতে খুব ভালোবাসতেন। তাঁর কেতাদুরস্ত শাড়ি, ঝুমকা, আর খোলা চুল সবসময়ই যেন আকর্ষণীয় এক ব্যক্তিত্ব গড়ে তুলত। অরণ্য সুযোগ পেলেই পিসির কাছে বসে গল্প শুনত—বিশেষ করে তাঁর শপিং আর সাজগোজের গল্প।
সুলতা পিসি ছিলেন অরণ্যের সবচেয়ে প্রিয় আত্মীয়। তিনি মাঝে মাঝে তাদের বাড়িতে এসে দু’দিন থেকে যেতেন। তার চলাফেরা, সাজগোজ, আর ব্যক্তিত্বে একটা আলাদা আকর্ষণ ছিল। তার সাজগোজের সব জিনিসই অরণ্যের চোখে পড়ত। বড় বড় আলমারিতে সাজানো রঙিন শাড়ি, ঝলমলে গয়না, মেকআপ বক্স—সবকিছুই যেন একটা নতুন পৃথিবী।
একদিন পিসি বাড়িতে এলেন একগাদা ব্যাগ নিয়ে। তিনি বড় ব্যাগগুলো খুলে শাড়ি, ব্লাউজ আর নতুন গয়না বের করছিলেন। এরমধ্যে একটা লাল রঙের বেনারসী শাড়ি, ছোট নীল স্লিভলেস ব্লাউজ, আর বড় ঝুমকা দেখে অরণ্যের চোখ বড় হয়ে গেল।
দুপুরে পিসি বিশ্রাম নিতে ঘুমিয়ে পড়লেন। বাড়ির অন্যরাও তখন ঘুমোচ্ছে। অরণ্য মনে মনে ঠিক করল, আজ পিসির ঘরে একটু ঢুঁ মেরে দেখবে।
সে চুপিচুপি পিসির ঘরে ঢুকল। বড় আলমারিটা খুলতেই তার চোখে পড়ল নীল রঙের একটি সিল্ক শাড়ি। সেই শাড়ির পাশে রাখা ছিল ছোট একটা স্লিভলেস ব্লাউজ। শাড়ির মোলায়েম ভাব আর ঝলমলে রঙ দেখে সে যেন আর নিজেকে সামলাতে পারল না।
আস্তে করে শাড়িটা বের করে গায়ে জড়াতে চেষ্টা করল। পুরোপুরি শাড়ি পরতে পারল না সে, তবে আঁচলটা গায়ে পেঁচিয়ে নিজের চেহারার দিকে তাকাল আয়নায়। একটা ছোট্ট হাসি তার মুখে ফুটে উঠল। এরপর পিসির মেকআপ কেস থেকে একটা ছোট্ট লাল টিপ বের করে কপালে লাগাল। টিপ পরেই সে অনুভব করল যেন নিজের মধ্যে এক নতুন রূপ আবিষ্কার করছে।
কিন্তু হঠাৎ…
“কি রে অরণ্য, তুই কি করছিস?”
পিছন থেকে পিসির গলার আওয়াজ শুনে অরণ্য ভয়ে কাঁপতে লাগল। শাড়ি আর টিপসহ সে দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করল, কিন্তু পিসি হাসতে হাসতে তার হাত ধরে ফেললেন।
পিসি মুখে মুচকি হাসি নিয়ে বললেন, “আরে, এভাবে পালাচ্ছিস কেন? শাড়ি তোকে বেশ মানিয়েছে রে!“
অরণ্যের চোখে পানি এসে গেল। সে কাঁপা গলায় বলল, “পিসি, আমি শুধু… আমি শুধু মজা করছিলাম… তুমি কাউকে বলো না প্লিজ।“
পিসি এবার হাসি থামিয়ে তার পাশে বসে পড়লেন। অরণ্যের মাথায় হাত রেখে বললেন, “শোন, লুকিয়ে করার কিছু নেই। তোর যা ভালো লাগে, তা তুই করবি। সাজগোজ তো আনন্দের বিষয়, এতে লজ্জার কিছু নেই।“
অরণ্য অবাক হয়ে পিসির দিকে তাকাল। এতদিন ধরে নিজের পছন্দ নিয়ে সে লুকিয়ে থেকেছে, অথচ আজ পিসি তাকে বুঝতে পারছেন! পিসির সেই কথাগুলো যেন তাকে নতুন আশার আলো দেখাল।
পিসি আবার বললেন, “তুই কি সত্যি সত্যি শাড়ি আর গয়না পছন্দ করিস?“
অরণ্য লজ্জায় মাথা নিচু করে বলল, “হ্যাঁ পিসি, খুব পছন্দ করি। কিন্তু কেউ জানলে আমাকে নিয়ে হাসবে। ছেলে হয়ে এসব মানায় নাকি?“
পিসি মৃদু হেসে বললেন, “কে বলেছে এসব মানায় না? সাজগোজে কোনো লিঙ্গ নেই। শাড়ি, গয়না, মেকআপ—যার ভালো লাগে, সে-ই পরবে। আর তুই দারুণ সুন্দর দেখাচ্ছিলি এই শাড়িতে। চল, কাল আমরা শপিংয়ে যাব। তোর জন্য নতুন ড্রেস আর গয়না কিনে দেব।“
অরণ্যের চোখে আনন্দের ঝিলিক দেখা দিল। পিসির এই গোপন সমর্থন যেন তার মনের সব জড়তা ভেঙে দিল।
সেদিন সন্ধ্যাটা যেন অরণ্যের জীবনের এক নতুন অধ্যায়ের শুরু। পিসির ঘরে বসে নতুন কেনা শাড়ি আর গয়নার প্যাকেটগুলো খুলে রাখতেই ঘরটা যেন উজ্জ্বল হয়ে উঠল। পিসি বললেন, “আজ তোর প্রথম সাজ, তাই একটু সময় নিয়ে সাজাবো তোকে। বুঝলি? ধীরে ধীরে সবকিছু করব।” অরণ্য একটু অস্বস্তি নিয়ে বলল, “পিসি, আমি তো শাড়ি পরা জানি না। এটা খুব কঠিন না? যদি ঠিক করে না হয়?” পিসি হাসলেন, “আরে পাগল, আমি তো আছি! প্রথমে একটু কঠিন লাগবে, কিন্তু একবার পরা শিখে গেলে তুই নিজেই পরতে পারবি। শাড়ি পরা একটা শিল্পের মতো, ধৈর্য আর ভালোবাসা লাগে।” অরণ্য তখন পিসির মুখের দিকে তাকিয়ে একটু সাহস পেল। পিসি প্রথমে তাকে বসিয়ে রাখলেন এবং একটা সুন্দর লাল রঙের শাড়ি বের করলেন, যার সোনালি জরির কাজ নজর কেড়ে নেওয়ার মতো। তার সঙ্গে মিলিয়ে একটা স্লিভলেস ব্লাউজ, যার গলার কাটটা একটু গভীর আর ফিটিং চমৎকার। পিসি বললেন, “এই ব্লাউজটা তোর গায়ে খুব ভালো মানাবে। শাড়ি পরলে যখন এই ব্লাউজের হাতা না থাকার কারণে তোর হাতগুলো দেখা যাবে, তখন তুই নিজেও অবাক হয়ে যাবি তোর সৌন্দর্য দেখে।” অরণ্য কিছু না বলে একটু লজ্জা পেয়ে তাকিয়ে রইল।
এরপর পিসি অরণ্যকে দাঁড় করিয়ে শাড়ি পরানোর কাজ শুরু করলেন। প্রথমে কোমরের নিচে শাড়ির পাড় গুঁজে, ধীরে ধীরে ভাঁজ করতে করতে তাকে শিখিয়েও দিলেন কীভাবে শাড়ির পল্লু কাঁধে নিতে হয়। পিসি একদিকে শাড়ির কুঁচি ঠিক করে দিচ্ছিলেন, অন্যদিকে অরণ্য আয়নায় নিজের রূপের দিকে চেয়ে ভাবছিল, “এটা কি সত্যিই আমি?” পুরো শাড়ি পরানো শেষ হলে পিসি তার গায়ে ব্লাউজের ফিটিং ঠিক করলেন। এরপর পিসি তার আলমারি থেকে একটি বেনারসি ওড়না এনে অরণ্যের কাঁধে ফেলে বললেন, “এইবার দেখ তো!” অরণ্য একটু ঘুরে আয়নার সামনে দাঁড়াতেই নিজেকে দেখে বিস্মিত হয়ে গেল। এ যে এক নতুন মানুষ! নিজের দিকে তাকিয়ে তার চোখে এক অজানা আনন্দ আর আবেগের ঝিলিক দেখা দিল। পিসি খুশি হয়ে বললেন, “দেখলি? শাড়ি পরলেই যে কি সুন্দর লাগতে পারে সেটা তুই নিজেই বুঝতে পারলি। এবার গয়না পরে দেখি।“
এরপর পিসি একটা বড় মখমলের বাক্স খুলে ঝুমকা বের করলেন। সোনালি ঝুমকাটা অরণ্যের কানে পরিয়ে দিয়ে বললেন, “এই ঝুমকা গুলো আমার খুব প্রিয় ছিল। আজ থেকে এগুলো তোর জন্য।” ঝুমকা পরে অরণ্যের গাল ছুঁয়ে গিয়ে যখন কানে ঝুলে পড়ল, তখন তার অনুভূতিটা ছিল অবর্ণনীয়। এরপরে পিসি তার গলায় একটা সীতাহার পরিয়ে দিলেন, যার ঝলমলে পাথরগুলো আলোয় ঝিকিমিকি করছিল। তার পায়ে একটা রূপার পায়েল পরিয়ে দিয়ে পিসি খিলখিল করে হেসে উঠলেন, “এই পায়েলের শব্দ শোন। মনে হচ্ছে যেন ছোট্ট একটা বউ সাজিয়ে রেখেছি!” অরণ্যও হাসল, কিন্তু তার হাসির মধ্যে একটা লজ্জা আর অস্বস্তি মিশে ছিল। পিসি তার হাত ধরে বললেন, “লজ্জা পেতে হবে না। তুই তো খুব সুন্দর। এবার মেকআপটা কর।“
পিসি তাকে বসিয়ে খুব যত্ন করে মেকআপ শুরু করলেন। প্রথমে তার মুখে হালকা ফাউন্ডেশন লাগিয়ে পুরো ত্বককে মসৃণ করে তুললেন। এরপর চোখের উপরে হালকা গোলাপি আইশ্যাডো আর কাজল টেনে বললেন, “তোর চোখ খুব সুন্দর। কাজল লাগালেই অন্যরকম লাগে। আর এই ঠোঁটে হালকা লাল লিপস্টিক লাগাব।” লিপস্টিক লাগানোর সময় অরণ্যের ঠোঁট কাঁপছিল লজ্জায়। পিসি মৃদু হেসে বললেন, “চুপ করে থাক। তুই নিজেকে যদি সুন্দর না ভাবিস, তাহলে তোর সৌন্দর্য কেউ দেখবে না। তুই অনেক সুন্দর। এই কথা মাথায় রাখ।” লিপস্টিক লাগানো শেষ হলে, পিসি একদম শেষে একটা ছোট্ট লাল টিপ অরণ্যের কপালে পরিয়ে দিলেন। এরপর তাকে দাঁড় করিয়ে বললেন, “এইবার আয়নার সামনে দাঁড়া। নিজেকে দেখে নে।“
অরণ্য ধীরে ধীরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে যখন নিজের রূপের দিকে তাকাল, তখন তার মনে হলো, এটা কি সত্যিই সে? এই তো এক নতুন মানুষ। তার গায়ের শাড়ি, ঝুমকা আর সীতাহার যেন তাকে এক নতুন জগতে নিয়ে গেছে। সারা শরীরে পায়েলের শব্দ যেন মৃদু সঙ্গীতের মতো বেজে চলেছে। পিসি খুশি হয়ে বললেন, “আজ তুই শুধু সাজিসনি, আজ তুই নিজের আসল রূপটাকে চিনতে পেরেছিস। এটা তোর জীবনের প্রথম রূপ। তুই যেমন, তেমনি থাকবি। কারো জন্য বদলাবি না। তোর যা ভালো লাগে সেটাই করবি। আর তুই সবসময় সুন্দর। এই রূপটা তোরই।” সেদিন রাতে অরণ্যের মন আনন্দে ভরে গেল। সে আর তার পিসি সারারাত ধরে গল্প করল, নতুন জামা, গয়না আর মেকআপের ব্যাপারে আলোচনা করল। পিসি তাকে আরও বললেন, “এরপর থেকে আমরা অনেক কিছু করব। নতুন নতুন জামা কিনব, মেকআপ শিখব। আর তুই নিজের মতো করে বাঁচবি। আমার কাছে তুই সবসময় সেরা।” অরণ্য পিসির দিকে তাকিয়ে হেসে বলল, “তুমি না থাকলে আমি কখনোই নিজেকে খুঁজে পেতাম না, পিসি।” পিসি তার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, “তুই তো আমার গর্ব।” সেই রাত থেকে অরণ্য বুঝল, সে আর একা নয়। তার পাশে পিসির মতো একজন মানুষ আছে, যে তাকে বোঝে, ভালোবাসে এবং নিজের মতো করে বাঁচতে সাহায্য করবে।